আমরা সবসময় মনে করি সমাজকর্ম ও সমাজকল্যাণের পার্থক্য নেই কিন্তু আসলে এই দুইটির মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। সামাজিক কাজ এবং সামাজিক কল্যাণ দুটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ক্ষেত্র যা প্রায়শই বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে সমাজে তাদের আলাদা ভূমিকা এবং উদ্দেশ্য রয়েছে।
উভয় ক্ষেত্রেরই লক্ষ্য ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের মঙ্গল উন্নত করা, কিন্তু তারা তা বিভিন্ন উপায়ে এবং পদ্ধতির মাধ্যমে করে। এই নিবন্ধে, আমরা সমাজে তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং অবদান তুলে ধরে সামাজিক কাজ এবং সামাজিক কল্যাণের মধ্যে পার্থক্যগুলি অনুসন্ধান করব।
সমাজকর্ম ও সমাজকল্যাণের পার্থক্য কী?
সমাজ কর্ম
সমাজ কর্ম এমন একটি পেশা যা ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়কে তাদের মঙ্গল এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সামাজিক কর্মীরা হলেন প্রশিক্ষিত পেশাদার যারা বিভিন্ন সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তি-কেন্দ্রিক এবং শক্তি-ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। এখানে সামাজিক কাজের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
- সরাসরি ক্লায়েন্ট ইন্টারঅ্যাকশন : সামাজিক কর্মীরা ক্লায়েন্টদের সাথে ব্যক্তিগত, পরিবার বা গোষ্ঠী পর্যায়ে সরাসরি জড়িত হন। তারা ক্লায়েন্টদের চাহিদা মূল্যায়ন করে, কাউন্সেলিং এবং সহায়তা প্রদান করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য, আসক্তি, গার্হস্থ্য সহিংসতা বা গৃহহীনতার মতো নির্দিষ্ট সমস্যাগুলি মোকাবেলার পরিকল্পনা তৈরি করে।
- অ্যাডভোকেসি এবং কেস ম্যানেজমেন্ট : সমাজকর্মীরা প্রায়শই তাদের ক্লায়েন্টদের পক্ষে উকিল হিসাবে কাজ করে, নিশ্চিত করে যে তাদের সম্পদ, পরিষেবা এবং এনটাইটেলমেন্টগুলিতে অ্যাক্সেস রয়েছে। তারা কেস ম্যানেজমেন্টও প্রদান করে, কার্যকরভাবে ক্লায়েন্টদের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন পরিষেবার সমন্বয় করে।
- পেশাগত লাইসেন্স : অনেক দেশে, সামাজিক কর্মীদের অনুশীলনের লাইসেন্স থাকতে হবে, যার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করা এবং তত্ত্বাবধানে অভিজ্ঞতা অর্জন করা জড়িত।
- শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ : সমাজকর্মীরা সাধারণত সামাজিক কাজ বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে, যা তাদের মানব আচরণ, সামাজিক ব্যবস্থা এবং হস্তক্ষেপের কৌশলগুলির একটি শক্ত ভিত্তি প্রদান করে।
- হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ : সামাজিক কাজ শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, তাদের পরিবেশ, পারিবারিক গতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিকে বিবেচনা করে সমস্যাগুলি মোকাবেলার জন্য একটি সামগ্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করে।
সমাজ কল্যাণ
অন্যদিকে, সামাজিক কল্যাণ হল একটি বিস্তৃত ধারণা যা একটি সমাজ বা এর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মঙ্গল ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য ডিজাইন করা নীতি, কর্মসূচি এবং পরিষেবাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি সামাজিক সমর্থনের পদ্ধতিগত এবং কাঠামোগত দিকগুলি সম্পর্কে আরও বেশি। এখানে সামাজিক কল্যাণের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
- নীতি ও কর্মসূচী উন্নয়ন : সমাজকল্যাণ পেশাদাররা ম্যাক্রো স্তরে কাজ করে, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো সামাজিক সমস্যাগুলি মোকাবেলার লক্ষ্যে নীতি, কর্মসূচি এবং উদ্যোগগুলি বিকাশ ও বাস্তবায়ন করে।
- সম্পদ বরাদ্দ : তারা বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে সম্পদ এবং তহবিল বরাদ্দ করার জন্য দায়ী, যাতে তারা প্রয়োজনে জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করে।
- গবেষণা এবং বিশ্লেষণ : সমাজকল্যাণ বিশেষজ্ঞরা বিদ্যমান কর্মসূচির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে এবং পরিষেবা সরবরাহের ফাঁক সনাক্ত করতে গবেষণা পরিচালনা করেন। তাদের ফলাফল নীতি পরিবর্তন এবং প্রোগ্রামের উন্নতির কথা জানায়।
- আইন প্রণয়ন এবং অ্যাডভোকেসি : সমাজকল্যাণ পেশাদাররাও সরকারী নীতিগুলিকে প্রভাবিত করতে এবং সামাজিক কর্মসূচির জন্য তহবিল সুরক্ষিত করার জন্য অ্যাডভোকেসি প্রচেষ্টায় জড়িত হতে পারে।
- আন্তঃবিভাগীয় পদ্ধতি : সামাজিক কল্যাণে প্রায়শই সামাজিক সমস্যাগুলির ব্যাপক সমাধান বিকাশের জন্য অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং জনপ্রশাসন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাদারদের সাথে সহযোগিতা জড়িত থাকে।
সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ
১। সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ: সকল সামাজিক কুসংস্কার সমাজ উন্নয়নের পথে বাধা স্বরূপ। ব্যাপক জনমত তৈরি সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি আইন প্রণয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজ সংস্কার করা হয়। সমাজকর্ম এ লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে একটি।
২। প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা: সম্পদ বলতে বস্তুগত ও অবস্তুগত দুই ধরনের সম্পদ কে বোঝায়। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে যে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সম্পদ অপরিহার্য। কারণ সংগঠিত জনগণ এই শক্তি। তাই সামাজিক সমস্যার সমাধানের সম্পদ সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করায় সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য।
Google News: Amar Sikkha
৩। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্যা গ্রস্ত জনগণের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। আধুনিক সমাজকর্ম তাই সমষ্টিগত অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ করে থাকে। এটি তার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
৪। মানবসম্পদের উন্নয়ন: মানব সম্পদের উন্নয়ন মানে সমাজের উন্নয়ন। মানুষকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার নীতিতে সমাজকর্ম বিশ্বাস করে। দলমত নির্বিশেষে সমাজের সকলের মানুষের উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা আধুনিক সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য।
৫। সমন্বয় সাধন করা: সকল সরকারি ও বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাধনের মাধ্যমে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ করা সম্ভব। কারণ সমন্বয়হীন কাজের মাধ্যমে সুফল আশা করা যায় না। সমাজের মঙ্গলে নিয়োজিত সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য।
৬। জাতীয় উন্নয়ন: জাতীয় উন্নয়ন বলতে সমগ্র দেশের উন্নয়নকে বোঝানো হয়েছে। এখানে বিশেষ ব্যক্তি বা কোন অঞ্চলের উন্নয়নকে আনা যাবে না। সমাজের সকল শ্রেণীর উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নকে তরান্তরিত করা আধুনিক সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
৭। পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন: মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটলে অনেক সমস্যা রই সমাধান সম্ভব হয়। সমাজকর্ম চাই সমাজে সম্প্রীতি ও সৌন্দর্যমূলক পরিবেশ বজায় থাকুক। তাই মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সমাজের উন্নয়ন সাধন সমাজকর্মের লক্ষ্য।
৮। সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান: সমাজের প্রকৃত কল্যাণের জন্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান অত্যাবশ্যক। স্থায়ী সমাধান তখনই সম্ভব যখন সমস্যাটি বৈজ্ঞানিকভাবে মোকাবেলা করা হবে। সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত তথা স্থায়ী সমাধানের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন সাধন সমাজকর্মের লক্ষ্য।