ব্যাকরণ পরেণ অথচ ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় ও ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা জানেন না, তাহলে কি হবে? চলুন আজকের পোস্ট থেকে এই দুইটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জেনে নেই।
ভাষা হলো বেশকিছু বাক্যের সমষ্টি। আবার বাক্য গঠিত হয় অনেকগুলো অর্থপূর্ণ শব্দ দিয়ে। শব্দ তৈরি হয় এক বা একাধিক ধ্বনির সাহায্যে। এ থেকে বোঝা যায়, ভাষায় ক্ষুদ্রতম একক (উপাদান) ধ্বনি। এই ধ্বনি, শব্দ, বাক্য, অর্থ প্রতিটি বিষয় আলোচনা হয় ব্যাকরণে। অর্থাৎ ব্যাকরণে ভাষার চারটি উপাদান আলোচিত হয়। এগুলো হলো-
ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়
১. ধ্বনি (Sound)
২. শব্দ (Word)
৩. বাক্য (Sentence)
৪. অর্থ (Meaning)
এদিক থেকে সব ব্যাকরণের মতো বাংলা ব্যাকরণের প্রধান আলোচ্য বিষয় চারটি। যথা;
১. মানিতত্ত্ব (Phonology)
২. শব্দতত্ত্ব বা ধূপতত্ত্ব (Morphology)
৩. বাক্যতত্ত্ব বা পদক্রম (Syntax)
৪. অর্থতত্ত্ব বা বাগর্থতত্ত্ব (Semantics)
এছাড়াও অভিধানতত্ত্ব (Lexicography), ছন্দ প্রকরণ (Prosody) এবং অলংকার প্রকরণ (রিটোরিক) ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়।
বাংলা ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়
১. ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology): ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় ধ্বনি। ধ্বনির লিখিত রূপ হলো বর্ণ। তাই ধ্বনিতত্ত্বে বাগযন্ত্র, বাগযন্ত্রের উচ্চারণ-প্রক্রিয়া, ধ্বনির পরিচয়, ধানির বিন্যাস, ধধ্বনির উচ্চারণ প্রণালি, উচ্চারণের স্থান, উচ্চারণের বৈশিষ্ট্য, স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির বৈশিষ্ট্য, ধ্বনির পরিবর্তন, ধ্বনির প্রতীক, সন্দি, বর্ণের পরিচয় ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।
২. শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব (Morphology): শব্দের ক্ষুদ্রাংশকে বলা হয় রূপ (mospheme)। রূপ গঠন করে শব্দ। সেজন্য শব্দতত্ত্বকে রূপতত্ত্ব (morpheme) বলা হয়। ব্যাকরণের এ অংশে শব্দ, শব্দের শ্রেণি ও শদের গঠন, নর ও নারীবাচক শব্দ, উপসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি, বচন, নির্দেশক, সমাস ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।
৩. বাক্যতত্ত্ব বা পদক্রম (Syntax): বাক্য, বাক্যের গঠন ও শ্রেণি, বাক্যের বর্গ, বাক্য পরিবর্তন, বাক্যে পদের ক্রম, কারক, উক্তি, বাচ্য, বাক্য সংকোচন, বিরামচিহ্ন ইত্যাদি বিষয় ব্যাকরণের এ অংশের আলোচ্য বিষয়। বাক্যতত্ত্বকে পদক্রম নামেও অভিহিত করা হয়।
৪. অর্থতত্ত্ব বা বাগর্থতত্ত্ব (Semantics): শব্দের অর্থবিচার, অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ, মুখ্যার্থ, গৌণার্থ, বিপরীত শব্দ, শব্দজোড়, বাগধারা, প্রতিশব্দ ইত্যাদি অর্থতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়। এছাড়াও শব্দ ও বাক্যের ব্যঞ্জনা নিয়েও অর্থতত্ত্ব আলোচনা করে।
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
অনেকে মনে করেন, ব্যাকরণ না জেনেও ভাষা শুদ্ধভাবে আয়ত্ত করা যায়; কথাটা আংশিক সত্য। কারণ, ব্যাকরণ না জেনে ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের জন্য একটি আদর্শ ভাষা-পরিবেশ সরকার। কিন্তু বাস্তবে সে রকম একটা আদর্শ পরিবেশ প্রায় অস্তিত্বহীন। সমাজে অহরহ ভাষার ভুল প্রয়োগ হয় এবং শিশু বেড়ে ওঠে এ ত্রুটিপূর্ণ ভাষিক পরিবেশে। ব্যাকরণের নিয়ম জানা থাকলে ভাষার ভুল প্রয়োগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ব্যাকরণের কাজ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার নিয়ম বের করে লিপিবদ্ধ করাই ব্যাকরণের কাজ বা উদ্দেশ্য।’ ব্যাকরণের প্রধান কাজগুলো নিম্নে দেওয়া হলো-
- ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়মকানুনগুলো সুবিন্যস্ত করা।
- ভাষা সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করা।
- ভাষা বিশ্লেষণ করা।
- পড়তে, বলতে, বুঝতে ও লিখতে সাহায্য করা।
- ভাষাজ্ঞান বৃদ্ধি করা।
- ভাষার প্রয়োগ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
- সাহিত্যরস সৃষ্টি ও উপলব্ধিতে সাহায্য করা।
বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও ইতিহাস
বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে। ১৭৪৩ সালে বাংলা ব্যাকরণ রচনার সূত্রপাত করেন পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউ। এর ভাষা ছিল পর্তুগিজ। প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন ইংরেজ পণ্ডিত নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। তাঁর রচিত ব্যাকরণের নাম ‘এ গ্রামার অব দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’। ইংরেজিতে লেখা এই ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ সালে। উইলিয়াম কেরি ১৮০১ সালে ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। এটির দ্বিতীয় সংস্করণ বাংলায় অনূদিত হয়ে ১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাই বলা যায়, বাংলা ভাষায় প্রথম বাংলা ব্যাকরণ লিখেছেন উইলিয়াম কেরি।
বাঙালিদের মধ্যে ১৮২৬ সালে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন রাজা রামমোহন রায়। এটিও ইংরেজিতে রচিত। ১৮৩৩ সালে রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর রচিত ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ বাংলায় অনূদিত হয়। পরবর্তীকালে ড. সুনীতিকুমার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. সুকুমার সেন, ড. এনামুল হক প্রমুখ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় প্রয়াস পেয়েছেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখ বাংলা ভাষায় গল্প ও কবিতা লিখে বাংলা ভাষা আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।
Follow Us
Facebook Page: AmarSikkha.com
Linkedin: AmarSikkha.com
Google News: Amar Sikkha
WhatsApp Channel: Amar Sikkha
Telegram: t.me/amarsikkha