পোস্টমাস্টার গল্পতে বিঞ্জান প্রকৃতি প্রেম কে আলাদা মাত্রায় বোঝাতে চেয়েছেন লেখক । গল্পটি ভালভাবে বুঝতে হলে পোস্টমাস্টার গল্পের মূলভাব জানা জরুরি।
গল্পের প্রধান দুটি চরিত্রের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করেছে প্রকৃতি।। গল্পের বিস্তার ও পরিণতিতে প্রকৃতি অমোঘ প্রভাব বিস্তার করেছে। গল্পটির মোট সময়কাল নির্ধারণ করা না গেলেও এটা যে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে তার আন্দাজ গল্পে স্পষ্ট করা হয়েছে। এই গল্পজুড়ে বর্ষা ঋতুকে চিত্রিত করা হয়েছে তাই বলা যেতে পারে যে এটি কোন এক বর্ষাকালেরই।
পোস্টমাস্টার গল্পের মূলভাব
কলকাতা থেকে অজপাড়া গাঁয়ের পোস্টঅফিসে কাজ করতে আসা পোস্টমাস্টারের প্রতি এক অসহায় অনাথ গ্রাম্য-বালিকার সহজ সরল অথচ গভীর অনুভূতি এবং পোস্টমাস্টারের কাজ ছেড়ে চলে যাবার সময় বালিকার মনের অব্যক্ত আর্তি রবীন্দ্রনাথের এ গল্পকে এক মর্মস্পর্শী ও সকরুণ কাব্যধর্মীতায় মণ্ডিত করেছেন।এখানে চরিত্র বলতে দুটি – পোস্টমাস্টার আর রতন।
খানিকটা বর্ণনা ও খানিকটা কথোপকথনের রীতিতে গল্পটি নির্মিত।
গণ্ডগ্রামে শহুরে পোস্টমাস্টার হয়ে আসা এক ব্যক্তি ও তার একাকিত্ব দূর করেছে রতন নামক একটি মেয়ে, তাকে সঙ্গ দিয়ে, পরিচর্যা দিয়ে,গ্রাম্য-বালিকার স্বাভাবিক সারল্যে দিয়ে।।
পোস্টমাস্টার রতনের সাথে অনেক কথা বলেছে, তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে । এরপর পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দিনরাত সেবা-শুশ্রুষা করে ভালো করে তুলেছে রতন।এই পর্যন্ত দুই বিপ্রতীপ পুরুষ ও নারীর এক আন্তরিক সম্পর্কের গল্প।
কিন্তু তারপরই অকস্মাৎ যেন তার ছিঁড়ে যায়,বেসুরো হয়ে যায় সবকিছু। পোস্টমাস্টার পাড়াগাঁ ছেড়ে শহরে ফিরতে উদ্গ্রীব, বদলির দরখাস্ত পাঠান,দরখাস্ত নাকচ হলে চাকরি ছেড় ফিরে যাবার উদ্যোগ নেন নিজেই।রতনকে একথা জানালে সে হতবাক হয়ে যায়। পোস্টমাস্টারকে সে বলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। পোস্টমাস্টার এর উওর ছিল—’সে কি করে হবে ”
যাবার সময় পোস্টমাস্টার রতনকে আশ্বস্ত করে যে- নতুন পোস্টমাস্টারকে তিনি রতনের ব্যাপারে বলে যাবেন।নিজের পথখরচ বাদে বেতনের সব টাকাটা তিনি রতনকে দিতে চান।রতন তা নিতে চায় না।।
রতন পোস্টমাস্টার এর বিচ্ছেদে আকুল।। তার প্রেম কে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার পাঠক হৃদয় জুড়ে থেকে যাবে অনন্ত সময়।। কিন্তু সেই প্রেম বুঝতে হয়তো অনেক টাই দেরি হয়েছে পোস্টমাস্টার এর ।। তাইতো রতনের পোস্টমাস্টার খানিকটা বোকার মতো বলেছে যে নতুন পোস্টমাস্টার কে নাকি সে বলে যাবে যেন তিনি ভালো ব্যবহার করে।। এমনি টাকার দেওয়ার মতো একটা কথা, যা রতনের হৃদয় কে আহত করেছে।।
গল্পের শেষে দেখি পোস্ট মাস্টার নৌকায় উঠে রতনের কথা ভেবে তার করুণ মুখচ্ছবি মনে করে বিচলিত হয়েছে, এবং রতন এর কাছে যাওয়ার ভাবনা।। পোস্টমাস্টার এর মনে লুকিয়ে থাকা প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে যদিও নৌকা ঢের এগিয়েছে ততক্ষণে।
স্বল্প পরিসরে দুটি নর-নারীর নিভৃত মনের সংযোগ ও ঘটনাচক্রে তার করুণ পরিসমাপ্তি অতি সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ এ গল্পে।
বর্ষাকালের মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহর– এই সময়টাতে রতন ও পোস্টমাস্টার পরস্পরের হৃদয়ের কাছাকাছি এসেছে, গল্পের মাঝের অংশে কিংবা সম্পর্কের মধ্যভাগেও রয়েছে শ্রাবণের অন্তহীন বর্ষণ এবং গল্পের শেষাংশে পোস্টমাস্টারের বিদায় যাত্রায় রয়েছে বর্ষাবিস্ফোরিত নদীর বর্ণনা। কেবল পটভূমি রচনাতেও নয়, প্রকৃতিতে বর্ষার ছবি বেশ কিছু জায়গায় রতনের আবেগকে অনন্য ভাবে ইঙ্গিত করেছে।
রতনের অশিক্ষাকে দূর করার চেষ্টায় পোস্টমাস্টার রতনকে নিয়মিত অক্ষরজ্ঞান দিতে শুরু করেছিল। পোস্টমাস্টারের আন্তরিকতা রতনের মনে ভালবাসার বীজ বপন করেছে।।
দুটি চরিত্রের শ্রেণীগত অবস্থান ভিন্ন। এ ভিন্নতা জোরালো হয়েছে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে। যদিও পোস্টমাস্টার উচ্চবিত্ত শ্রেণীর নয়, সে সামান্য বেতনের একজন পোস্টমাস্টার কিন্তু রতনের অবস্থান তার অনেক নিচে, মনিবভৃত্যের সম্পর্কের মতো কারণ কাজের বিনিময়ে রতন চারটে খেতে পায়। খানিকটা বর্ণনা ও খানিকটা কথোপকথনের রীতিতে গল্পটি নির্মাণ করা হয়েছে। । লেখাপড়া শেখার ফাঁকে ফাঁকে পোস্টমাস্টার ও রতনের গল্প জমে উঠতে লাগল। পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লে দিনরাত সেবা করে তাকে সুস্থ করে তুলল। সে সময় লেখকের উচ্চারণে ‘বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না’ এই কথা থেকে স্পষ্ট হয় ,রতন প্রেমিকা হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে।
পোস্টমাস্টার চলে যাবার কথা রতনকে বলার পর পর পুরো পরিবেশটা এভাবে চিত্রিত হয়েছে অনেকক্ষণ আর কেউ কোন কথা বলল না।” মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার ওপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।”— এ চিত্রটি রতনের মনের অবস্থাকে চিত্রিত করে। এই প্রদীপের আলো গল্প এর শুরুতে দেখা গেছিলো উজ্জ্বল ভাবে যখন পোস্ট মাস্টার রতন কে ডেকেছিলেন।। তাকে লেখা পড়া শেখানো এবং তখন তাকে যুক্তাঅক্ষর শেখায় এক্ষেত্রে শুধুমাত্র অক্ষর নয় দুটি হৃদয় ও যুক্ত হয়ে যেতে শুরু করে।।
শেষে পোস্টমাস্টারের প্রতি রতনের প্রেমের সূত্রটি খুবই ক্ষীণ মিটমিট করে জ্বলা প্রদীপের মতো এবং আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় রতনের হৃদয়বেদনা টপটপ করে পড়া বৃষ্টির জলের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘
গল্পের শেষাংশের দীর্ঘশ্বাসজনিত উচ্চারণ ‘হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয় ‘রতনের নারী প্রেমকে উপস্থাপিত করে।
প্রেমিকা রতন আবেগ দ্বারা তাড়িত, পোস্টমাস্টারের বিচ্ছেদে পাগল প্রায় আর অন্যদিকে পোস্টমাস্টারের হৃদয়ে রতনের জন্য প্রেম থাকলেও সে বাস্তবের তাড়নায় তা অস্বীকার করে সামনে এগিয়ে যায়।।
অজপাড়াগাঁ ছেড়ে কলকাতা শহরের দিকে মন ধাবিত এক পোস্টমাস্টার, তাই সে রতন এর কাছে ফিরে যাবে কিনা এই দ্বিধাকে সহজে এড়িয়ে যেতে পারে। দুই সামাজিক মেরুর দুই প্রান্তের দু’জন নর-নারীর পক্ষে সমাজকে অস্বীকার করে শুধু হৃদয়ের টানে সারা জীবন কাছাকাছি থাকার স্বপ্ন যে সত্যি হতে পারে সেই অবদ্ধি উত্তীর্ণ হতে পারেনি।। নায়ক পোস্টমাস্টার দ্বিধাগ্রস্ত, প্রেম কে কাছে চেয়ে, প্রেমের সঙ্গ কে অনুভব করলেও তাকে কাছে রাখতে ব্যর্থ আর পোস্ট মাস্টার এর প্রশয়ে সমস্ত ভালোলাগা দেওয়ার পর ও রতন ভালোবাসা পায়নি, বদলে খানিকটা দয়া যা রতন এর হৃদয় ব্যথিত ও অপমানিত করেছে।
Good