দান সম্পর্কে হাদিস ও এর ফজিলত

ইসলামে দানের ফজিলত নতুনভাবে বর্ণনা করার কিছু নেই। দান সম্পর্কে হাদিস শরীফে অনেক কিছুই বর্ণনা করা হয়েছে। আবদান (রহঃ) ও বিশর ইবনু মুহাম্মদ (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।

রমযানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমযানের প্রতি রাতেই জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন।

দান সম্পর্কে হাদিস 

১. সায়ীদ ইবনে ইয়াসার (রহঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি হালাল উপায়ে অর্জিত মাল সদকা করে, আল্লাহ তা’আলা হালাল অর্থাৎ পবিত্রকেই কবুল করেন – তাহা হইলে উক্ত সদকা সে আল্লাহর হাতে দিল। আল্লাহ্ পাক তাহাকে এইভাবে লালন-পালন করেন, যেইভাবে তোমরা ঘোড়ার বাচ্চা কিংবা উটের বাচ্চা লালন-পালন কর। শেষ পর্যন্ত সেই সদকা (বর্ধিত হইয়া) পর্বতসমান হইয়া যায়।

২.রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ».

“তোমারা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ (নিজেকে রক্ষা কর) যদিও তা খেজুরের টুকরা দ্বারাও হয় (সামান্য বস্তু সদাকা করতে পারলেও তা কর)”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৬)

৩. মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ».

“এবং সাদাকা (যাকাত) বা দান খায়রাত) গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। এমনিভাবে গভীর রাতে ব্যক্তির কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জু্র)ও গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়। (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২০১৬)

৪. হাকীম বিন হিযাম (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন উঁচু (দাতা) হাত নিচু (গ্রহীতা) হাত অপেক্ষা উত্তম। তাদের মাধ্যমে ব্যয় করা আরম্ভ কর যাদের তুমি প্রতিপালন করছ। সবচেয়ে উত্তম হল সেই দান, যার পর সচ্ছলতা অবশিষ্ট থাকে (অর্থাৎ যে দানের পর অভাব না আসে।) আর যে ব্যক্তি (যাচ্ঞা হতে) পবিত্র থাকার চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখবেন এবং যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষী থাকার চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী (অভাবমুক্ত) রাখবেন। (বুখারী ১৪২৭)

সর্বশ্রেষ্ঠ দান বা সাদকা

عَن سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ الصَّدَقَةِ أفضل؟ قَالَ: سقِِي المَاء

১। সা’দ বিন উবাদাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! কোন দান সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ? তিনি উত্তরে বললেন, পানি পান করানো। (আবু দাউদ ১৬৮১, ইবনে মাজাহ ৩৬৮৪)

আরও পড়ুন  নামাজের মাকরুহ সমূহ ১ তালিকায়

عَن سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ أَنَّهُ قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ أُمَّ سَعْدٍ مَاتَتْ فَأَىُّ الصَّدَقَةِ أَفْضَلُ قَالَ الْمَاءُ قَالَ فَحَفَرَ بِئْرًا وَقَالَ هَذِهِ لأُمِّ سَعْد

 ২। সা’দ হতেই বর্ণিত, তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল! উম্মে সা’দ (আমার মা) মারা গেছে। অতএব কোন্ দান সবচেয়ে উত্তম হবে? তিনি বললেন, পানি।

বর্ণনাকারী বলেন, সুতরাং সা’দ (রাঃ) একটি কুয়া খনন করে বললেন, এটি উম্মে সা’দের। (আবু দাঊদ ১৬৮৩)

গোপনে দান সম্পর্কে হাদিস

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: صَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى , وَصِلَةُ الرَّحِمِ تَزِيدُ فِي الْعُمُرِ وَفِعْلُ الْمَعْرُوْفِ يَقِي مَصَارِعَ السُّوءِ

আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন গোপনে দান প্রতিপালকের ক্রোধ দূরীভূত করে, জ্ঞাতি-বন্ধন অক্ষুন্ন রাখে, আয়ু বৃদ্ধি করে। আর পুণ্যকর্ম সর্বপ্রকার কুমরণ থেকে রক্ষা করে। (বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ৩৪৪২, সহীহুল জামে ৩৭৬০)

স্ত্রীর দান

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِذَا أَنْفَقَتِ الْمَرْأَةُ مِنْ طَعَامِ بَيْتِهَا غَيْرَ مُفْسِدَةٍ كَانَ لَهَا أَجْرُهَا بِمَا أَنْفَقَتْ وَلِزَوْجِهَا أَجْرُهُ بِمَا كَسَبَ وَلِلْخَازِنِ مِثْلُ ذَلِكَ لاَ يَنْقُصُ بَعْضُهُمْ أَجْرَ بَعْضٍ شَيْئًا

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মহিলা যখন তার (স্বামী) গৃহের খাদ্য হতে (অনিষ্ট বা) অপব্যয় না করে (ক্ষুধার্তকে) দান করে, তখন তার জন্য তার দান করার সওয়াব হয়। তার স্বামীর জন্য তার উপার্জন করার সওয়াব লাভ হয়। আর অনুরূপ সওয়াব লাভ হয় খাজাঞ্চীরও। ওদের কেউই কারো সওয়াব কিছুমাত্র কমিয়ে দেয় না।(বুখারী ১৪২৫, মুসলিম ২৪১১-২৪১৩)

দান সম্পর্কে হাদিস, ফজিলত ও শর্ত 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকার ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন : তা বিপদ দূরীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেমন তিনি বলেছেন :

«لَمَّا خَلَقَ اللَّهُ الأَرْضَ جَعَلَتْ تَمِيدُ، فَخَلَقَ الجِبَالَ، فَقَالَ بِهَا عَلَيْهَا فَاسْتَقَرَّتْ، فَعَجِبَتِ المَلَائِكَةُ مِنْ شِدَّةِ الجِبَالِ. قَالُوا: يَا رَبِّ هَلْ مِنْ خَلْقِكَ شَيْءٌ أَشَدُّ مِنَ الجِبَالِ؟ قَالَ: نَعَمُ الحَدِيدُ. قَالُوا: يَا رَبِّ فَهَلْ مِنْ خَلْقِكَ شَيْءٌ أَشَدُّ مِنَ الحَدِيدِ؟ قَالَ: نَعَمُ النَّارُ. فَقَالُوا: يَا رَبِّ فَهَلْ مِنْ خَلْقِكَ شَيْءٌ أَشَدُّ مِنَ النَّارِ؟ قَالَ: نَعَمُ المَاءُ. قَالُوا: يَا رَبِّ فَهَلْ مِنْ خَلْقِكَ شَيْءٌ أَشَدُّ مِنَ المَاءِ؟ قَالَ: نَعَمُ الرِّيحُ. قَالُوا: يَا رَبِّ فَهَلْ مِنْ خَلْقِكَ شَيْءٌ أَشَدُّ مِنَ الرِّيحِ؟ قَالَ: نَعَمْ ابْنُ آدَمَ، تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ بِيَمِينِهِ يُخْفِيهَا مِنْ شِمَالِهِ»

আরও পড়ুন  মহিলাদের তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত

‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন পৃথিবী সৃষ্টি করেন তখন তা দুলতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাতে পর্বত সৃষ্টি করলে তা স্থির হয়ে যায়। তা দেখে ফেরেশতাগণ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন : প্রভু হে! পর্বতের চেয়ে শক্তিশালী তোমার অপর কোন সৃষ্টি আছে কি? আল্লাহ বললেন: ‘হ্যাঁ, এর চেয়ে শাক্তশালী হলো লোহা।’ তারা বললেন : প্রভু হে! লোহার চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন : ‘‘হ্যাঁ, তা হলো আগুন।’’ তারা বললো : প্রভু হে! আগুনের চেয়ে শাক্তিশালী কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন : ‘হ্যাঁ, আগুনের চেয়ে শক্তিশালী হলো বাতাস। তারা আবার বললো : প্রভু হে! বাতাসের চেয়ে শক্তিশালী কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন : ‘হ্যাঁ, আদম সন্তান উদার চিত্তে যে দান করে তা (বিপদ দূরীকরণের ক্ষেত্রে) বাতাসের চেয়েও অধিক শক্তিশালী।’’

সদকা বা দান সঠিক হওয়ার শর্ত 

সদকা করার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম, এতে কারো দ্বি-মত নেই। কিন্তু এ সদকা সঠিক হওয়া ও এটিকে উপাসনায় পরিণত করার জন্য যে দু’টি পূর্ব শর্ত রয়েছে, সে সম্পর্কে অনেকেরই জ্ঞানের অভাব রয়েছে।

সদকা সঠিক হওয়ার প্রথম শর্ত : সদকা স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক যে অবস্থায়ই করা হোক না কেন তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই হতে হবে। কোনো প্রকার লোক দেখানো ভাব থেকে তা মুক্ত হতে হবে।

দ্বিতীয় শর্ত :

উপরে বর্ণিত দাহহাক রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসের মর্মানুযায়ী যে স্থানের নামে সদকা করা হয়েছে সে স্থানটি শির্ক সংঘটিত হওয়ার সম্ভাব্য স্থান হওয়া থেকে মুক্ত হতে হবে।এ দু’টি শর্তের আলোকে বলা যায়, কেউ যদি সদকা করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির পাশাপাশি সামান্যতম লোক দেখানোরও উদ্দেশ্য করে, তবে এতে সে ব্যক্তি শির্কে আসগরে নিমজ্জিত হবে। আর কবর ও মাযার যেহেতু শির্ক সংঘটিত হওয়ার সম্ভাব্য স্থান, সেহেতু সেখানে সদকা করার কোনো বৈধতা নেই। যেহেতু শরী‘আতে মাযার নির্মাণ অবৈধ এবং মাযারে দান করাও অবৈধ, তাই মাযারের অবৈধ টাকায় সেখানে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলাও অবৈধ।

মাযারে টাকা দান করা যেহেতু হারাম, সুতরাং সেখানে কোনো ফকীর, মিসকীন ও ভবঘুরে লোকদেরও ভিড় জমাবার কোনো আবশ্যকতা নেই। সাধারণত মাযারে যারা দান করে তারা এ দানের মাধ্যমে মাযারস্থ অলির সন্তুষ্টি লাভ করে তাঁর নিকট থেকে বা তাঁর মাধ্যম্যে আল্লাহর নিকট থেকে তাদের দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ সাধনের জন্যেই তা দান করে। এ জাতীয় দান ও কামনা শির্কে আকবারের অন্তর্গত। কাজেই সাদকা দানের ক্ষেত্রে শির্ক থেকে বাঁচতে হলে যে সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অলিদের মাযার কেন্দ্রিক নয়, কেবল সেখানেই সাদকা করতে হবে।

We will be happy to hear your thoughts

Leave a reply

Amar Sikkha
Logo