গ্রীষ্মকাল রচনা [৬-১০] শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী গ্রীষ্মকাল বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাসজুড়ে থাকে। এ সময় প্রচণ্ড রোদে ভূমি শুকিয়ে যায়, নদ-নদীর নাব্যতা কমে এবং মাটিতে ফাটল ধরে। গ্রীষ্মের শেষদিকে সন্ধ্যায় কালবৈশাখী ঝড় দেখা যায়।

গ্রীষ্ম হলো বছরের উষ্ণতম সময়, যা উত্তর গোলার্ধে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শীতপ্রধান দেশে এই সময়টিতে কৃষিকাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়।বৈশাখ মাস দিয়ে বাংলা বছরের শুরু হয়। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাঙালিরা উৎসবমুখর পরিবেশে নতুন বছরকে বরণ করে।

গ্রীষ্মকাল রচনা 

ভূমিকা

বাংলা ছয় ঋতুর প্রথম ঋতু হলো গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মের অন্তর্ভুক্ত। এ ঋতু যেমন তীব্র তাপদাহ, খরা, পানি সংকট আর ক্লান্তি নিয়ে আসে, তেমনি এর একটি রঙিন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ দিকও রয়েছে। বাংলা সংস্কৃতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবও এই সময়েই পালিত হয়। গ্রীষ্মকাল প্রকৃতির এক বিশিষ্ট রূপ; যার প্রভাব পড়ে সমাজ, সংস্কৃতি, কৃষি ও জনজীবনে।

গ্রীষ্মের আবহাওয়া ও প্রকৃতির রূপ

গ্রীষ্মকালে সূর্য থাকে উত্তরের দিকে হেলে। ফলে দিন বড় হয়, রাত ছোট হয়ে আসে। এ সময় সূর্যতাপ এত বেশি হয় যে ভূমি, গাছপালা ও জলাশয় শুকিয়ে যায়। মাটিতে ফাটল ধরে, নদী-নালা হয়ে পড়ে নাব্যতাহীন। দুপুরবেলায় বাতাস থাকে স্থির, প্রকৃতি ক্লান্ত ও অবসন্ন। মানুষের জীবন হয়ে পড়ে কষ্টসাধ্য। তবে গ্রীষ্মের শেষদিকে সন্ধ্যা নামার সময় ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড় যা কখনো গরমের কষ্ট কিছুটা লাঘব করে, আবার কখনো ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রীষ্ম ও সংস্কৃতি 

বৈশাখের প্রথম দিনই বাংলা নববর্ষের সূচনা। পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশাল উৎসব। এদিন শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যায়। ঢাকায় রমনা পার্কে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং গ্রামীণ মেলায় এক অনন্য সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ তৈরি হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবকে সাহিত্য ও সঙ্গীতে তুলে ধরেছেন। তিনি নববর্ষকে দেখেছেন নবজাগরণের প্রতীক হিসেবে। উৎসবের দিনে মানুষ হয়ে ওঠে বৃহৎ এই বিশ্বাসে তিনি বলেছিলেন:

আরও পড়ুন  রোমান্টিক লাভ লেটার ও প্রেমের চিঠি

“প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী
কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ…”

গ্রীষ্মের ফুল ও পুষ্পরাজ্য

যদিও বসন্তকে পুষ্পঋতু বলা হয়, প্রকৃত পক্ষে গ্রীষ্মও কম নয় ফুলের বাহার নিয়ে। এ সময় কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল, জারুল, গুলাস, জ্যাকারান্ডা, জিনিয়া, ক্যাজুপুট, কামিনী, সোনালু প্রভৃতি ফুল গ্রীষ্মকে রাঙিয়ে তোলে। কৃষ্ণচূড়ার তীব্র লাল রঙ গ্রীষ্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের নানা শহরে গ্রীষ্মের এই ফুলের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে। এই ফুলগুলো প্রকৃতিকে যেমন সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলে, তেমনি মানসিক প্রশান্তিও দেয়।

গ্রীষ্মের ফলের সম্ভার

গ্রীষ্মের সবচেয়ে বড় উপহার হলো এর মৌসুমি ফল। আম, কাঁঠাল, জাম, তরমুজ, লিচু, বেল, আনারস, পেঁপে, তাল, আমলকি, কামরাঙা ইত্যাদি ফলে বাজার ভরে ওঠে। এই সব ফল সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। আমে রয়েছে ভিটামিন এ ও সি; কাঁঠাল শক্তিবর্ধক; তরমুজে প্রচুর পানি থাকায় এটি শরীরে পানিশূন্যতা দূর করে; জাম রক্তে আয়রনের জোগান দেয়; পেঁপে হজমে সহায়ক। বেল ঠান্ডা শরবতের জন্য বিখ্যাত এবং গ্রীষ্মজনিত রোগ থেকে রক্ষা করে।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সতর্কতা

গ্রীষ্মকাল শুধু ফল, ফুল ও উৎসবের নয়—এ সময় মানুষের জন্য নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দেয়। অতিরিক্ত গরমের ফলে ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া, বমি, বদহজম, জ্বর প্রভৃতি রোগ দেখা দিতে পারে। তাই এ সময়ে বিশুদ্ধ পানি পান, হালকা ও সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ এবং সরাসরি রোদ এড়ানো জরুরি। অতিরিক্ত গরমে শিশু ও বৃদ্ধদের বিশেষভাবে সতর্ক রাখতে হয়।

এটুকু লিখে উপসংহার দিবে ক্লাস (৬-৮) শ্রেণির শিক্ষার্থী 

গ্রীষ্মকাল ও কৃষি

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। তাই গ্রীষ্মকাল কৃষির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। গ্রীষ্মকালে বোরো ধান কাটা শুরু হয়। কৃষকেরা এই সময় মাঠে দিনরাত পরিশ্রম করেন। গ্রীষ্মের রোদ আর গরম সত্ত্বেও তাঁদের মুখে থাকে ফসল ঘরে তোলার আনন্দ। তবে অতিরিক্ত খরা ও পানির সংকট অনেক সময় চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটায়। সেচের পানির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়, ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। তবুও অনেক ফসল—যেমন গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি (পুঁই, ডাঁটা, লাউ, করলা, চিচিঙ্গা), বাদাম, তিল ইত্যাদি চাষে এ সময় সুফল মেলে। কৃষি প্রধান এই দেশে গ্রীষ্মকাল কৃষি-অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আরও পড়ুন  HSC ICT MCQ Questions and Answers pdf - এইচএসসি আইসিটি mcq

গ্রীষ্মকালের জীববৈচিত্র্য

গ্রীষ্মে গাছপালা কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেলেও জীবজগতে এক ধরনের সজীবতা লক্ষ্য করা যায়। অনেক পাখি এই সময় বাসা বাঁধে। কোকিল, শালিক, দোয়েল, চড়ুই, মাছরাঙা, টিয়া, ময়না ইত্যাদি পাখির ডাক গ্রীষ্মকালীন সকালে এক প্রাকৃতিক সুর তৈরি করে। এ সময় মধু সংগ্রহের জন্য মৌমাছিরা সক্রিয় থাকে। কিছু প্রাণী খরা ও পানির অভাবে কষ্টে পড়ে—তবে তাপমাত্রা বাড়লেও জীবজগতে প্রাণের তৎপরতা কমে না। এ সময় গৃহপালিত পশু-পাখির যত্ন নেওয়াও জরুরি হয়ে ওঠে।

গ্রামীণ জীবনে গ্রীষ্মকাল

গ্রামের মানুষদের জীবনে গ্রীষ্ম এক অন্য রকম অনুভব নিয়ে আসে। বাচ্চারা স্কুল ছুটি পেলে আম-কাঁঠালের বনে দৌড়ঝাঁপ করে, গাছে উঠে কাঁচা আম পাড়ে, খালে-ডোবার ঠান্ডা জলে সাঁতার কাটে। দুপুরের রোদে গাছতলায় বসে মাটির হাঁড়ি থেকে বেল শরবত খাওয়ার আনন্দই আলাদা। বিকেলবেলা গাছের নিচে বসে গল্প করা, খেলাধুলা, ও কাঁচা আমে লবণ-মরিচ মেখে খাওয়ার স্মৃতি আজও শহরের মানুষের কাছে রোমান্টিক।

শহরে গ্রীষ্মকাল

অন্যদিকে শহরে গ্রীষ্মকাল বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ঘনবসতি, যানজট, দূষণ ও কংক্রিটের দালানগুলোর কারণে গরম অনেক বেশি অনুভূত হয়। বিদ্যুৎ বিপর্যয়, পানির সংকট এবং অতিরিক্ত রোদ শহুরে জীবনে কষ্ট বাড়িয়ে তোলে। ছোট ফ্ল্যাটবন্দি শিশুরা গ্রামের মতো মুক্ত খেলাধুলার সুযোগ পায় না। তবে এ সময় ফলের বাজার জমজমাট থাকে এবং ফুচকা, তেঁতুল-জল, বেল শরবত, তাজা আনারস ইত্যাদি ঠান্ডা খাদ্য ও পানীয় বিক্রেতাদেরও দেখা যায় শহরের অলিতে-গলিতে।

গ্রীষ্মকাল ও শিশুদের সময় কাটানো

এই সময় শিশুদের কাছে থাকে গ্রীষ্মকালীন ছুটি। কেউ গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়, কেউ বই পড়ে, কেউ আবার মোবাইল-কম্পিউটারে গেম খেলায় সময় কাটায়। গ্রামে ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে আম কুড়ায়, মাছ ধরে, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শহরের শিশুদের জন্য এই আনন্দ কল্পনার মতো, যদিও কিছু কিছু পার্ক বা সুইমিং পুলে তাদের গরমকাল উপভোগের সুযোগ থাকে।

উপসংহার

গ্রীষ্মকাল প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় এক ঋতু। এর একদিকে যেমন আছে তীব্র রোদ, খরা ও ক্লান্তি, অন্যদিকে রয়েছে রঙিন ফুল, পুষ্টিকর ফল, এবং নববর্ষের উৎসব। গ্রীষ্মে আমাদের জীবনে আসে নতুন সূচনা ও উদ্যম। তাই কিছু কষ্টসাধ্য দিক থাকা সত্ত্বেও গ্রীষ্মকাল বাংলা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য ও সৌন্দর্যময় ঋতু।

We will be happy to hear your thoughts

Leave a reply

Amar Sikkha
Logo