ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় নির্দেশক বৈশিষ্ট্যকে ক্রিয়ার কাল বলে। ক্রিয়ার কাল একটা ব্যাকরণিক ধারণা। তা সাধারণ সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। যেমন: আমরা যখন বলি, ‘প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল নেপালে যাচ্ছেন’ তখন আমরা ভবিষ্যৎ কালের কথা বলি। কিন্তু ‘যাচ্ছেন’ ক্রিয়াপদ থেকে বোঝা যায় যে আমরা ক্রিয়ার বর্তমান কালের রূপ ব্যবহার করেছি। অন্যদিকে, আমরা যখন বলি, ‘তিনি দশ বছর আগে মারা গেছেন’ তখন আমরা অতীত সময়ের কথা বলি, কিন্তু ‘গেছেন’ ক্রিয়াপদ থেকে বোঝা যায় আমরা ক্রিয়ার বর্তমান কালের রূপ ব্যবহার করেছি। সুতরাং বর্তমানের ক্রিয়া দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যৎ সময় বোঝানো সম্ভব।
ক্রিয়ার কালের শ্রেণিবিভাগ
ক্রিয়ার কাল প্রধানত তিনটি।
১. অতীত,
২। বর্তমান,
৩। ভবিষ্যৎ
বর্তমান কাল
ক্রিয়ার যে রূপে এখন হচ্ছে, হয় বা চিরকাল হয়ে থাকে- এমন কিছু বোঝায়, তাকে সাধারণভাবে বর্তমান কাল বলে গণ্য করা হয়। নির্দেশক ভাব ও অনুজ্ঞা ভাব- এ দুই ক্ষেত্রেই বর্তমান কালের ব্যবহার হয়েছে। নির্দেশক ভাবে বর্তমান কাল তিন রকম। যথা:
ক. সাধারণ বর্তমান
খ. ঘটমান বর্তমান
গ. পুরাঘটিত বর্তমান
অনুজ্ঞা ভাবে বর্তমান কালের শ্রেণির নাম হলো:
ঘ. বর্তমান অনুজ্ঞা
ক. সাধারণ বর্তমান
ক্রিয়ার যে কালরূপ নিয়মিত বা সাধারণত ঘটে এমন অবস্থা বোঝায় তাকে সাধারণ বর্তমান কাল বলে। একে নিত্য বর্তমান কালও বলা হয়। যেমন: তিনি জানেন। সকালে সূর্য ওঠে। আমি রোজ ভোরে উঠি।
সাধারণ বর্তমান কালের বিশিষ্ট প্রয়োগ
১. চিরন্তন সত্য প্রকাশে: দুই আর দুইয়ে চার হয়।
২. উত্তম পুরুষ অনুজ্ঞায়: দেখি কী করতে পারি।
৩. অনুমতি প্রার্থনায়: এবার তবে আসি।
৪. ঐতিহাসিক বর্তমান নির্দেশে: অতীতের কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনায় কিংবা প্রয়োগে যদি অতীত কালের জায়গায় বর্তমান কালের প্রয়োগ হয়, তাহলে এ ধরনের প্রয়োগকে বলা হয় ঐতিহাসিক বর্তমান। যেমন: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় (হয়েছিল অর্থে)। বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন দিল্লির বাদশাহ হন (হয়েছিলেন অর্থে)।
৫. যদি, যখন, যতক্ষণ, যে বার, পাছে ইত্যাদি থাকলে কিংবা অতীত কালের উল্লেখ থাকলে সাধারণ বর্তমানের ক্রিয়া অতীত কালের পরিচায়ক হয়। যেমন: সেবার যখন জলোচ্ছ্বাস হয় আমি তখন স্কুল ছেড়েছি। ও কেমন করে ছবি আঁকে তা-ই দেখছিলাম। তিনি যখন ট্রেন থেকে নামেন তখনো বেশ আলো ছিল।
৬. প্রাচীন লেখকের উদ্ধৃতি দিতে বর্তমানের সাহায্যে অতীত কালের প্রকাশ: চণ্ডীদাস বলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
৭. বর্ণনীয় বিষয়কে প্রত্যক্ষ গোচর করতে বর্তমান কালের সাহায্যে অতীতের প্রকাশ: আমি দেখতে পেলাম, কারা যেন ছুটে আসছে।
৮. সাধারণ বর্তমানের শেষে নাই, নি ইত্যাদি নিষেধার্থক অব্যয় যোগ করে অতীত কালের প্রকাশ: বাবা গত রাতে বাড়ি ফেরেননি। তুমি গতকাল অফিসে যাওনি।
৯. যখন, যেমন, যেন, যদি, যতক্ষণ ইত্যাদির সাহায্যে কিংবা সংশয় বুঝিয়ে বর্তমান কালের সাহায্যে ভবিষ্যতের প্রকাশ: আপনি যদি চান তো ছ মাস পরই ফিরব। বাবা যেমন বলেন সেইমতো কাজ করবে। তিনি যেন না আসেন।
১০. অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রকাশে: কে বলবে, সে দেশে ফিরছে কি না।
১১. অব্যবহিত ভবিষ্যৎ বোঝাতে: কাল হরতাল হয় কি না, দেখা যাক। ওষুধটা কোথায় পাওয়া যায় তা ভালো করে জেনে আসবি।
খ. ঘটমান বর্তমান
ক্রিয়া সংঘটন শেষ হয়নি এখনো চলছে বোঝাতে ক্রিয়ার কালের যে রূপ হয়, তাকে ঘটমান বর্তমান কাল বলে। যেমন: তপু বাঁশি বাজাচ্ছে। লীনা গান গাইছে। মামুন বল খেলছে।
ঘটমান বর্তমান কালের বিশেষ প্রয়োগ
১. অতীত কালের প্রকাশ: সেনাপতি জানালেন, সৈন্যরা পিছু হটছে। বাড়িটা নদীর ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা শহরে চলে এলাম।
২. ভবিষ্যৎ কালের প্রকাশ: বাবা আগামী পরশু আসছেন। ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত বিদায় নিচ্ছি না। আজ সোমবার, পরশু হচ্ছে বুধবার। ঘটমান বর্তমান কখনো কখনো বিশেষণ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন: আসছে বছর আমি উনিশে পড়ব।
গ. পুরাঘটিত বর্তমান
ক্রিয়া কিছুক্ষণ আগে ঘটেছে এবং তার ফল এখনো রয়েছে, এমনটি বোঝানোর জন্য ক্রিয়ার যো কাল হয় তাকে পুরাঘটিত বর্তমান কাল বলে। ‘পুরাঘটিত’ শব্দের অর্থ হলো: ‘আগে ঘটেছে এমন’। সেজন্য পুরাঘটিত বর্তমান কাল বর্তমানে পরিব্যাপ্ত অতীতের ধারণা দেয়। যেমন:
সাধারণ বর্তমান: আনিস ঢাকায় থাকে।
পুরাঘটিত বর্তমান: আনিস দুই মাস ঢাকায় আছে।
পুরাঘটিত বর্তমানের বিশেষ প্রয়োগ
১. অতীত সময় বোঝাতে: দশ বছর হলো তার বাবা মারা গেছেন। গত মাসে তাকে ঢাকায় দেখেছি।
২. ভবিষ্যৎ সময় বোঝাতে: সে-ও এসেছে আর তোমারও যাওয়া হয়েছে।
২. অতীত কাল
বর্তমান সময়ের আগে সংঘটিত হয়েছে বা স্থিত ছিল এমনটি বোঝাতে ক্রিয়ার কালের যে রূপ ব্যবহৃত হয় তাকে অতীত কাল বলে। সাধারণভাবে অতীত কালের রূপ চারটি। যথা:
ক. সাধারণ অতীত
খ. ঘটমান অতীত
গ. পুরাঘটিত অতীত
ঘ. নিত্যবৃত্ত অতীত
ক. সাধারণ অতীত
বর্তমান সময়ের আগে সংঘটিত ক্রিয়ার সময়টুকু বোঝাতে ক্রিয়ার কালের যে রূপ ব্যবহৃত হয় তাকে সাধার অতীত কাল বলে। একে নিত্য অতীত কালও বলা হয়। সাধারণ অতীত কাল নির্দিষ্ট সময়কে নির্দেশ করে। যেমন: তিনি বইটা পড়লেন। তুমি আকাশের দিকে তাকালে। মেঘ করতে না করতেই বৃষ্টি এলো।
সাধারণ অতীত কালের বিশেষ ব্যবহার
১. সাধারণ অতীতের ক্রিয়ারূপ দিয়ে বর্তমান নির্দেশ: ইনি হলেন আমার মামা। ওকে তোমার কাছে রেখে গেলাম (যাচ্ছি)। এখন হলো কম্পিউটারের যুগ।
২. বর্তমান মুহূর্তের তাৎক্ষণিক ঘটনা বর্ণনায়: মুশফিক ছক্কা হাঁকালেন, বল উড়ে গেল মাঠের বাইরে। এখন জানলাম, তুমি আমাকে পছন্দ করো না। তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি গেলাম।
৩. আসন্ন ভবিষ্যৎ সময় বোঝাতে: একটু দাঁড়াও, আমি এই এলাম। তাকে হয়তো জানালাম, কিন্তু তিনি মানবেন তো? সে এখনো এলো না, আমাদের ডোবাল দেখছি। কাপড়গুলো ঘরে তোলো, বৃষ্টি এলো বলে।
খ. ঘটমান অতীত
ক্রিয়া সংঘটনের কাজ অতীতে কিছু সময় ধরে চলছিল- এমন বোঝাতে ক্রিয়ার যে রূপ ব্যবহৃত হয় তাকে ঘটমান অতীত কাল বলে। ঘটমান অতীত কাল ক্রিয়ার সমাপ্তি নির্দেশ করে না; বরং যে সময়ের কথা বলা হয় তখনো কাজটি শেষ হয়নি বোঝায়। যেমন:
সাধারণ অতীত: সেদিন সকালে আমি বইটা পড়লাম।
ঘটমান অতীত: সেদিন সকালে আমি বইটা পড়ছিলাম।
প্রথম বাক্যে ক্রিয়ার সমাপ্তি বোঝাচ্ছে। দিনটি শেষ হওয়ার আগেই বস্তা বইটি পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যে ক্রিয়ার অসম্পূর্ণতা বোঝাচ্ছে। বক্তা ওই দিন বইটি পুরো পড়ে ফেলেছিলেন এমন অর্থ এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘটমান অতীত কালের বিশেষ ব্যবহার
ঘটমান অতীত কখনো কখনো বর্তমান সময় বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন: তুমি এসে গেছ! এতক্ষণ তোমার কথাই ভাবছিলাম (= ভাবছি)।
গ. পুরাঘটিত অতীত
ক্রিয়া সংঘটনের কাজ অতীতে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে এবং তারপর আরও ঘটনা ঘটে গেছে, এমন অবস্থা বোঝাতে ক্রিয়ার যে রূপ হয়, তাকে পুরাঘটিত অতীত কাল বলে। যেমন: সেবার আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম। গত বছর আমাকে বইমেলায় দেখেছিলেন। ১৯৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
অতীতে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনায় পুরাঘটিত অতীত কাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন: মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ লোক শহিদ হয়েছিল। তুমি গত বছর নেপালে গিয়েছিলে।
পুরাঘটিত অতীত সাধারণত অতীতে সংঘটিত কোনো কাজের আগে সংঘটিত কাজের ধারণা দেয়। যেমন: ট্রেন ছাড়ার আগেই আমরা স্টেশনে পৌছেছিলাম। আমি গতকাল যাকে দেখলাম, তাকে গত মাসে আমাদের বাসায় দেখেছিলাম।
খ) ঘটমান অতীত কাল:
যে সকল ক্রিয়া দ্বারা কোন কাজ অতীত কালে হইতেছিল বা ঘটিতেছিল ইত্যাদি বুঝালে ঘটমান অতীত কাল হয়। অথবা, যে ক্রিয়া অতীত কালে চলছিল বোঝায়, তাকে ঘটমান অতীত কাল বলে।
চিনিবার উপাই: – বাংলা ক্রিয়ার শেষে তেছিলাম, তেছিলে, তেছিলেনা ইত্যাদি চিন্হ থাকবে।
উদাহরণ:-
- মালি বাগানে ফুল তুলতেছিল।
- গরুগুলি মাঠে ঘাস খাইতেছিল।
- আমি গোসল করিতেছিলাম এবং আমার মা আমার জন্য নাস্তা তৈরী করিতেছিল।
- আমাদের ক্লাশ ভালই চলিতেছিল।
- ছেলেটা ভালই খেলিতেছিল।
গ) পুরা ঘটিত অতীত কাল:
অতীতের যে কাজটি বহু পূর্বেই ঘটে গেছে এবং পরে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, ঐ ক্রিয়ার কাল কে পুরা ঘটিত অতীত কাল বলা হয়।
চিনার উপায় (Indication): – বাংলা বাক্যের ক্রিয়ার শেষে ল, লে, লাম , লেন, ইত্যাদি চিণ্হ থাকে এবং পূর্বে, পরে কথা উল্যেখ থাকে।
উদাহরণ:-
- ডাক্টার আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা গেল।
- রুবি আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা গেল।
- পার্কে যাওয়ার পর আমি আমার প্রেমিকার সাথে দেখা করলাম।
- আমার দাদা মারা যাবার পর আমি অজ্ঞান হলাম।
- টেনস শেষ করার পর আমরা ইংরেজিতে কথা বলতে শুরূ করলাম।
- প্রেমিক তার প্রেমিকার বিয়ের কথা শোনার পন আত্নহত্যা করল।
ঘ) নিত্য অতীত কাল:
অতীক কালে কোন কিছু করতাম বা করত এরূপ বুঝালে নিত্য অতীত কাল হয়। অথবা, অতীত কালে প্রয়ই য়টত এইরূপ বুঝালে নিত্য অতীত কাল হয়। যেমন-
- আমি প্রতিদিন সাতার কাটতাম।
- আমি সকালে ঘুম থেকে উঠতাম।
- তারা নদীর তীরে ঝিনুক কুড়াত।
Contact Us
Gazipur City-1700, Dhaka, Bangladesh.
Contact: 013
Mail: bisshas5169@gmail.com
Facebook: Bisshas Prodhan